ঈদের চাঁদ, একলা মন
প্রেম, পরিবার আর বাধার গল্প
রাতুল আর মেহনাজ। দু’জন একসঙ্গে স্কুলে পড়ে, একসঙ্গে স্বপ্ন দেখে, একসঙ্গে পথ চলতে চায়। ওরা দু’জনেই এই বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী। কেবল পড়ালেখাই নয়, দু’জনের মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসা তো সবসময় সহজ পথ ধরে হাঁটে না।
ওদের সম্পর্কটা যখন পরিবার জানতে পারে, তখনই সবকিছু বদলে যেতে থাকে। রাতুলের মা-বাবা কড়া ধরণের মানুষ। তাদের কাছে ছেলের প্রেম-ভালোবাসা মানেই পথভ্রষ্ট হওয়া। আর মেহনাজের পরিবার? তারাও খুব রক্ষণশীল। মেয়ের স্বপ্ন দেখার অধিকার থাকলেও, ভালোবাসার অধিকার নেই। দু’জনকে আলাদা করে দেওয়া হলো। কোনোভাবেই যেন ওরা আর যোগাযোগ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা হয়ে গেল।
দূরত্বের দিনগুলো
প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হচ্ছিল দু’জনের। ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, দেখা করা তো দূরের কথা। তবে রাতুল সবসময়ই একরকম পথ খুঁজে বের করতো। কখনো বন্ধুর ফোন থেকে মেহনাজের খবর নেওয়ার চেষ্টা করতো, কখনো স্কুলে দূর থেকে ওকে দেখার চেষ্টা করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে কষ্ট জমতে লাগলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন সবকিছুই বদলে যেতে থাকলো।
এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা মাস। তারপর এল সেই দিন, যেদিন সবাই খুশি থাকে, আনন্দ করে—ঈদ!
ঈদের আগের রাত
৩০ মার্চ ২০২৫। চাঁদ উঠেছে। পুরো আকাশ যেন আলোয় ভরে গেছে। চারদিকে খুশির আমেজ। কিন্তু রাতুলের মনে কোনো খুশি নেই। বাড়িতে সবাই ব্যস্ত, ঈদের জন্য নতুন কাপড় কেনা হয়েছে, বাহারি খাবার রান্না হচ্ছে। কিন্তু রাতুলের মনে একটাই চিন্তা—এই ঈদে মেহনাজ নেই।
ওদের কত পরিকল্পনা ছিল! আগের বছর ঈদের দিন যখন দেখা হয়েছিল, মেহনাজ বলেছিল,
“পরের ঈদটা আমরা একসঙ্গে কাটাবো, কেমন?”
কিন্তু নিয়তি যেন এক ভয়ংকর খেলা খেলেছে। এবার ঈদের দিনটা একসঙ্গেতো নয়ই, বরং এমন দূরত্বে যে, কোনো যোগাযোগই নেই। রাতুল ছাদে উঠে বসে থাকে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতে থাকে, “মেহনাজ, তুমি কেমন আছো? তুমি কি আমাকে মনে করছো?”
ঈদের সকাল: এক আনন্দ, এক কষ্ট
৩১ মার্চ ২০২৫। ঈদের দিন। সারা বাড়িতে আনন্দের ঝলক। সবাই নতুন জামা পরে, ঈদের নামাজে যায়। কিন্তু রাতুল? ওর মুখে কোনো হাসি নেই। ঈদের নতুন পোশাক পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে, কিন্তু নিজেকে যেন অচেনা লাগে। মনে হয়, হাসিটা কেমন যেন হারিয়ে গেছে।
ওদিকে মেহনাজের বাড়িতে উৎসবের আমেজ। ওর মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই মিলে ঈদের দিনটা উপভোগ করছে। মেহনাজও পরিবারের সাথে হাসছে, খাচ্ছে, আনন্দ করছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে পড়ছে রাতুলের কথা। ঈদের নামাজ শেষে বাবা যখন ওকে বলে, “আমার মেয়ে কত খুশি, তাই না?”
ও হাসে। কিন্তু মনে এক চাপা শূন্যতা কাজ করে। ও কি সত্যিই খুশি? না কি শুধু দেখানোর জন্য হাসছে?
একলা দুপুর, চোখের পানি
সকালটা কাটল পরিবারের সাথে। দুপুরের খাবার শেষ হতেই সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু রাতুলের মন ছটফট করছে। সে ছাদে উঠে আসে। শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে, মন থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনে পড়ে, গত ঈদের দুপুরে মেহনাজকে একবার দেখতে গিয়েছিল সে। কত হাসিখুশি ছিল ওরা!
আজ সে একা। মনে হচ্ছে, বুকের ভেতর একটা বিশাল শূন্যতা জমে আছে। এই শূন্যতা বোঝার কেউ নেই। বাড়ির সবাই খুশি, কিন্তু তার হৃদয় রক্তাক্ত।
ও ধীরে ধীরে মোবাইল হাতে নেয়। অনলাইনে যায়, ভাবে মেহনাজ কি কিছু পোস্ট করেছে? কিছুই নেই। হঠাৎ বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখের কোনায় পানি জমে আসে। ঈদের দিনে কেউ কাঁদে না, তাই না? কিন্তু সে কাঁদছে।
কেউ জানে না, এই উৎসবের দিনে তার হৃদয়ের ভেতর কী যন্ত্রণা জমে আছে।
ভালোবাসার দূরত্ব
ঈদের বিকেলবেলা, চারপাশে হৈচৈ, কিন্তু রাতুল একা নিজের রুমে বসে। মেহনাজের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে কি এখন হাসছে? নাকি আমাকেই ভাবছে? ভাবতে ভাবতে রাতুল মোবাইলটা নিয়ে অনলাইনে আসে। হঠাৎ একটা ছবি চোখে পড়ে—মেহনাজ তার পরিবারের সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, নতুন জামা পরা।
রাতুলের বুকের ভেতর একটা ধাক্কা লাগে। সে ছবিটা অনেকক্ষণ ধরে দেখে, যেন প্রতিটা মুহূর্ত হৃদয়ে গেঁথে রাখার চেষ্টা করছে। তার মনে হতে থাকে, মেহনাজ যদি সত্যিই তাকে এত ভালোবাসতো, তাহলে কি এত সহজে ভুলে যেতে পারতো? সে কি সত্যিই খুশি নাকি এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে অব্যক্ত কষ্ট?
রাতুল মোবাইল বন্ধ করে দেয়। তার মনে হয়, ভালোবাসা কি এতই দুর্বল যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হয়ে যায়? সে জানে না। কিন্তু তার কষ্টটা সত্যি।
শেষ দেখা, অজানা ভবিষ্যৎ
এসএসসি পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। ১০ এপ্রিল, ২০২৫—প্রথম পরীক্ষা। দু’জনই জানে, এটা তাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও, একে অপরের চিন্তা মন থেকে যায় না।
পরীক্ষার প্রথম দিন স্কুলে দেখা হয়। চোখে চোখ পড়ে, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলে না। দূরত্ব যেন আরও গভীর হয়ে গেছে। তবে কি এটাই শেষ দেখা? পরীক্ষা শেষে রাতুল অপেক্ষা করে, যদি মেহনাজ একবার কথা বলে। কিন্তু না, সে দূর থেকেই বাসায় চলে যায়।
রাতুলের বুকটা ফেটে যায়, কিন্তু কিছুই করার নেই। সে শুধু মনে মনে বলে, “ভালো থেকো মেহনাজ। হয়তো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে...”
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন