নিঃস্বার্থ প্রেম
শহরের এক কোণে ছোট্ট একটা ক্যাফে। ভেতরে নরম হলুদ আলো, চারপাশে গুনগুন করে বাজছে সুরেলা সংগীত। জানালার ধারে বসে আছে অরণি। তার হাতের কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কিন্তু সে খেয়ালই করেনি। চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে ক্যাফের দরজার দিকে।
হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো শুভ। বহু বছর পর দেখা, অথচ মনে হলো যেন এই তো সেদিন শেষবার কথা হয়েছিল। শুভর মুখে হাসি, হাতে একটা উপহার।
—"অরণি! কেমন আছো?"
অরণি একটু হাসলো, সেই চিরচেনা মায়াভরা হাসি।
—"ভালো। তুমি?"
শুভ বসে পড়লো তার সামনে। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো, যেন হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো দিনে।
প্রথম পরিচয়
অরণি আর শুভর প্রথম দেখা কলেজের ক্লাসরুমে। শুভ ছিল শান্ত, ভদ্র, আর একদম সিরিয়াস ধরনের ছেলে। আর অরণি? সে ছিল পুরো উল্টো—সবসময় চঞ্চল, হাসিখুশি। প্রথম দিনই দুইজনের একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। শুভ ভেবেছিল, অরণি একটু বেশি বাচাল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারলো, এই মেয়েটার ভেতরে আছে অদ্ভুত এক উষ্ণতা, একরকম আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা।
বন্ধুত্ব গভীর হতে বেশি সময় লাগেনি। ক্লাসের পরে লাইব্রেরিতে বসে পড়া, ক্যান্টিনে একসঙ্গে চা খাওয়া, কলেজের প্রাঙ্গণে হাঁটতে হাঁটতে অজস্র গল্প করা—সবই একসময় অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু শুভর জীবনে প্রেমের জন্য জায়গা কম ছিল। সে ছিল দরিদ্র পরিবারের ছেলে। বাবা-মা আর ছোট বোনের দায়িত্ব তার ওপর। সে জানতো, জীবনে সফল হতে না পারলে তার এই হাসি-খুশি দিনগুলোও থাকবে না। তাই বন্ধুত্ব যত গভীরই হোক, সে কখনোই তার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেনি।
অরণি বুঝতে পারতো শুভর অবস্থান। সে জানতো, শুভ তার পরিবারের জন্য নিজের জীবন উজাড় করে দেবে, তাই সে কখনো শুভকে কিছু বলার সাহস পায়নি। শুধু দূর থেকে ভালোবাসতো, নীরবে।
বিচ্ছেদ ও অপেক্ষা
কলেজ শেষে শুভ স্কলারশিপ পেলো দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য। সে জানালো অরণিকে, আর তখনই প্রথমবার অরণির মনে হলো, তার কিছু একটা বলা উচিত ছিল। কিন্তু কথাগুলো গলায় আটকে গেল।
—"তুই তো অনেক বড় হবি, তাই না?"
—"হ্যাঁ, হয়তো! কিন্তু জানিস, মাঝে মাঝে খুব ভয় লাগে।"
—"ভয় কিসের?"
—"সব ছেড়ে যেতে হবে। পুরনো জায়গা, পুরনো মানুষগুলো…"
অরণি হাসলো।
—"ভয় পাস না। তুই সফল হবি, দেখিস!"
শুভ চলে গেলো। আর অরণি? সে অপেক্ষা করতে লাগলো, কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই। মাঝে মাঝে শুভর মেইল আসতো, ফোন আসতো, কিন্তু ধীরে ধীরে সেগুলো কমতে শুরু করলো।
একদিন খবর এলো, শুভর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তার পরিবারের লোকজন পছন্দ করে দিয়েছে একটি মেয়ে। শুভ রাজি হয়েছে, কারণ সে জানতো, দায়িত্ব অনেক।
অরণির সেই রাতে প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল। কিন্তু সে কারও সামনে কিছু বুঝতে দেয়নি। শুভকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মেসেজ পাঠালো, আর তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে আরও ব্যস্ত করে তুললো।
কিন্তু তবু, শুভর জন্য দোয়া করা বন্ধ করলো না।
ফের দেখা
বছর পাঁচেক পর শুভ দেশে ফিরলো, সঙ্গে তার স্ত্রী ও ছোট্ট একটা সন্তান। পুরনো বন্ধুরা সবাই মিলে একটা ছোট রিইউনিয়নের আয়োজন করলো।
অরণি প্রথমে যেতে চায়নি, কিন্তু শেষমেশ গেলো। শুভর সঙ্গে কথা হলো, হালকা স্মৃতিচারণ হলো, কিন্তু কিছুই আগের মতো ছিল না।
সেদিন রাতে শুভ জানতে পারলো, অরণি আজও অবিবাহিতা।
—"তুই বিয়ে করিসনি কেন?"
অরণি হাসলো।
—"জীবনে বিয়েটাই সব না, শুভ!"
শুভ কিছু বলল না। কিন্তু সেদিন প্রথমবার তার মনে হলো, কেউ একজন তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিল, কোনো শর্ত ছাড়াই।
কিছু ভালোবাসা পাওয়া হয় না, কিছু ভালোবাসা বোঝা হয় দেরিতে।
আর কিছু ভালোবাসা শুধু দূর থেকেই রয়ে যায়—নিঃস্বার্থ, নীরব, অথচ চিরন্তন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন