নিঃস্বার্থ প্রেম – পর্ব ২
শুভ সেদিন রিইউনিয়ন থেকে ফিরে আসার পর সারারাত ঘুমোতে পারেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বারবার অরণির কথাগুলো মনে পড়ছিল।
"জীবনে বিয়েটাই সব না, শুভ!"
সত্যিই কি তাই? তাহলে কেন অরণির চোখের গভীরে চাপা একটা বেদনা ছিল? শুভ জানত, কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।
অরণির জীবন
শুভর বিয়ের পর অরণি নিজেকে নতুনভাবে গুছিয়ে নিয়েছিল। একটা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিল সে, বাচ্চাদের পড়ানোর মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল। সে বুঝে গিয়েছিল, জীবনের সব গল্প প্রেম আর সংসারে শেষ হয় না—কারও গল্প লেখা হয় নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অধ্যায়ে।
স্কুলের বাচ্চারা ছিল অরণির নতুন পরিবার। তাদের হাসি, দুষ্টুমি, আর ছোট ছোট জিজ্ঞাসাগুলোই ছিল তার জীবনের রঙ। কিন্তু মাঝে মাঝে, একলা রাতে, শুভর কথা মনে পড়তো। হয়তো ভাবতো, যদি একবার বলতো, তাহলে কি গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো?
শুভর উপলব্ধি
শুভের জীবন বাইরে থেকে সুখী মনে হলেও, ভেতরে কোথাও যেন একটা শূন্যতা ছিল। তার স্ত্রী মেহুল ভালো মানুষ, তাদের একটা ফুটফুটে ছেলেও আছে, কিন্তু কোথায় যেন একটা শীতলতা লেগে থাকে সম্পর্কটায়।
মেহুল ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিল, শুভর হৃদয়ের কোনো একটা অংশ অতীতের কোথাও আটকে আছে। সে কখনো জিজ্ঞেস করেনি, শুধু দূর থেকে দেখেছে শুভর বদলে যাওয়া।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে শুভ হঠাৎই একটা পরিচিত জায়গায় থামলো—তাদের পুরনো কলেজের সামনে। তার মনে পড়লো সেই দিনগুলোর কথা, যখন লাইব্রেরিতে বসে অরণির সঙ্গে গল্প করতো, যখন ক্যান্টিনের এক কাপ চায়ে ভাগ বসাতো দুজন।
সেদিন সে সিদ্ধান্ত নিলো, অরণির সঙ্গে আবার দেখা করবে।
অপ্রত্যাশিত দেখা
শুভ সরাসরি অরণির স্কুলে চলে গেলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনলো, অরণি আজ স্কুলে আসেনি।
—"ম্যাডাম কয়েকদিন ধরে একটু অসুস্থ, তাই ছুটি নিয়েছেন," একজন সহকর্মী জানালো।
শুভর বুকের ভেতর কেমন যেন একটা অজানা আশঙ্কা কাজ করলো। সে দ্রুত অরণির বাসার ঠিকানা জোগাড় করে বেরিয়ে পড়লো।
অরণির বাসার দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে অরণি—ক্লান্ত, একটু দুর্বল, তবু সেই চিরচেনা মায়াভরা হাসিটা মুখে লেগে আছে।
—"তুই? হঠাৎ এখানে?"
—"তুই অসুস্থ, তাও জানালিও না?" শুভর কণ্ঠে অভিযোগের সুর।
অরণি হেসে বললো, "এতো ছোটখাট জ্বর-সর্দির কথা কি তোকে বলতে হবে?"
শুভ ভেতরে ঢুকে বসলো। ঘরটা খুবই সাধারণ, কিন্তু কোথাও একটা অদ্ভুত শান্তি ছিল। শুভ একসময় চুপ করে অরণির দিকে তাকিয়ে বললো,
—"তুই কেন বিয়ে করোনি, অরণি?"
অরণি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে বললো,
—"কারণ আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম, শুভ। আর আমি জানতাম, তুই আমাকে কোনোদিনই ভালোবাসতে পারবি না, কারণ তোর ভালোবাসার থেকেও বড় ছিল তোর দায়িত্ব।"
শুভ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এতদিন ধরে যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল, সেটার উত্তর এত সহজ ছিল!
—"তুই… সত্যিই এতটা ভালোবাসিস আমাকে?" শুভর গলা কেঁপে গেলো।
অরণি মৃদু হেসে বললো,
—"ভালোবাসা কি শুধু পাওয়া বা প্রাপ্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ? আমি তো তোকে দূর থেকে সুখী দেখলেই খুশি ছিলাম।"
শুভর চোখে জল চলে এলো। এত বছর পর সে বুঝতে পারলো, অরণি শুধু একজন বন্ধু ছিল না—সে ছিল তার জীবনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার একমাত্র মানুষ।
শেষ অধ্যায়
সেদিন শুভ বাসায় ফিরে এলো, কিন্তু তার মন শান্ত হয়নি। কয়েকদিন পর আবার গেলো অরণির বাসায়, কিন্তু এবার দরজা খুললো এক বৃদ্ধা, অরণির প্রতিবেশী।
—"তুমি কি জানো, মেয়েটা কেমন ভালো মানুষ ছিল?" বৃদ্ধা বললেন।
শুভর বুক কেঁপে উঠলো। "ছিল?"
—"অরণি তো আর নেই, বাবা। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই…"
শুভর পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো।
সেইদিন প্রথমবার সে বুঝলো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আসল মানে কী।
কিছু মানুষ চুপচাপ ভালোবাসে, কোনো দাবি ছাড়াই। কিছু মানুষ শুধু অন্যের সুখের জন্যই বাঁচে, নিজের চাওয়া-পাওয়াকে ভুলে গিয়ে।
শুভ হয়তো সারা জীবন নিজের ভালোবাসার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি, কিন্তু অরণির ভালোবাসা চিরকাল তার হৃদয়ে বেঁচে থাকবে—নিঃস্বার্থ, নীরব, অথচ চিরন্তন।
চলবে..........
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন