রক্তে লেখা ভালোবাসা
প্রথম দেখায় বিরক্তি
নতুন ক্লাস। নতুন বইয়ের গন্ধ। জানলার পাশে বাতাসে নড়ে ওঠা পর্দা, আর পুরোনো বেঞ্চের কাঠের ঘ্রাণ—সব মিলিয়ে এক অন্যরকম সকাল।
ক্লাস টেনে উঠে এসেই স্কুলের পরিবেশ যেন কিছুটা পাল্টে গেছে তৃষার চোখে। আগে ছিলো সবকিছু চেনা, আর এখন—নতুন মুখ, নতুন চ্যালেঞ্জ।
তৃষা সকালে একটু দেরি করেই স্কুলে পৌঁছাল। ক্লাসরুমে ঢুকেই তার চোখ গেল জানালার পাশে প্রিয় সিটটার দিকে। সেটা ফাঁকা থাকার কথা, কিন্তু আজ সেখানে বসে আছে একজন ছেলে—কালো চুল, ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা লিখছে। ছেলেটার নাম সে জানে না, তবে চেহারাটা কিছুটা পরিচিত লাগছে।
তৃষা ধীরে ধীরে বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
— “এইটা আমার সিট, উঠবেন প্লিজ?”
ছেলেটা মুখ তুলে তাকাল। চোখে একরাশ ঠান্ডা ব্যঙ্গ।
— “তোমার সিট? এই বেঞ্চটা তোমার নামে বুক করা নাকি?”
তৃষা এক মুহূর্ত থমকে গেল। তার অভ্যাস, কেউ কিছু বললে চুপ করে থাকাটা একদম পছন্দ নয়।
— “হ্যাঁ, আমি এখানেই সবসময় বসি। আপনার বসার জায়গা অন্য কোথাও খুঁজে নিন।”
ছেলেটা হেসে ফেলল।
— “নাম কী তোমার, ম্যাডাম? কনডাক্টরের মতো এত জোরে উঠিয়ে দিচ্ছো?”
তৃষার রাগ চরমে।
— “তোমার মতো অভদ্র ছেলের সাথে কথা বলার ইচ্ছেই নেই আমার!”
— “তবুও বললে তো!” ছেলেটা মুচকি হেসে বলল, চোখ না তুলে।
এই প্রথম পরিচয়—তৃষা আর তানভিরের। একদম বাজে ছাপ ফেলল একে অপরের উপর।
পরদিন থেকে যেন প্রতিদিনই তাদের একটা ঝামেলা হবেই—কখনও ক্লাসের সিট নিয়ে, কখনও হোমওয়ার্কের খাতা হারিয়ে যাওয়া নিয়ে, কখনও স্রেফ চোখাচোখি হলেই ঝগড়া।
একদিন টিফিন টাইমে তৃষা বান্ধবী আনিকার কাছে গিয়ে বলল,
— “এই ছেলেটা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে রে! মুখে তো একটা মিষ্টি হাসি, কিন্তু কথাগুলা একেবারে বিষ!”
আনিকা হেসে বলল,
— “তুইও কম না! দেখলে তোকে আর শান্ত মেয়ে বলে কেউ চিনবে না।”
অন্যদিকে, তানভির তার বন্ধু রাফিকে বলল,
— “এই মেয়েটা একটা আগুন। সামনে গেলে মনে হয় এক্ষুণি পুড়িয়ে দেবে!”
রাফি হেসে জবাব দিল,
— “তুই সামনে গেলেই আগুন লাগে, বুঝিস না!”
এভাবেই শুরু—একটা তীব্র বিদ্বেষ। কেউ কারো অস্তিত্ব সহ্য করতে পারত না। কিন্তু আস্তে আস্তে এই ঝগড়াগুলোই যেন তাদের জীবনের একটা নিয়মিত অংশ হয়ে দাঁড়াল। স্কুলের শিক্ষকরাও অভ্যস্ত হয়ে গেল তাদের ঝামেলায়।
তবে কেউ জানতো না, এই ঝগড়ার পেছনে যে এক অদ্ভুত টান গড়ে উঠছে। তারা নিজেরাও জানত না, কবে কোন দিনে এই বিদ্বেষ একদিন হয়ে উঠবে তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অনুভব—ভালোবাসা।
স্কুলজীবনের প্রতিদিনের সূর্য ওঠা যেন এক নিয়মে বাঁধা পড়ে গেছে—সকাল ৮টা, ক্লাস শুরু, আর তানভির-তৃষার ঝগড়া দিয়ে দিন শেষ! তারা যেমন একে অপরকে সহ্য করতে পারত না, তেমনি কোনো দিন কথা না কাটলে দিনটাই যেন অপূর্ণ থেকে যেত।
কিন্তু সময় যে এক জায়গায় থেমে থাকে না।
একদিন দুপুরে স্কুলে এক বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। দুই পক্ষ—“পক্ষ” আর “বিপক্ষ”—এর জন্য ক্লাস টেন থেকে কয়েকজন শিক্ষার্থী বাছাই করা হয়। শিক্ষকেরা দলভুক্ত করলেন। ভাগ্য এমনই—তৃষা ও তানভির একই দলে পড়ে গেল!
তৃষা বিস্ময়ে বলে উঠল,
— “স্যার! আমি... আমি ওর সাথে এক টিমে কাজ করতে পারব না।”
তানভিরও হাত তুলে বলল,
— “স্যার, আমি একাই বলব, ওকে বাদ দিন!”
স্যার হেসে বললেন,
— “ভালো টিমওয়ার্ক শিখতে হবে। আর যদি না পারো, তবে প্রতিযোগিতার স্বপ্ন বাদ দাও।”
দুজনেই মুখ গোমড়া করে সম্মতি জানালো। মনের মধ্যে ক্ষোভ, কিন্তু কিছু করার নেই।
পরবর্তী কয়েকদিন বিতর্কের প্রস্তুতি চলতে থাকল। প্রথম দিন তো তারা কথা বলতেই চাইছিল না। একেকজন একেকভাবে বক্তব্য লিখে রাখে। দ্বিতীয় দিন কিছুটা চোখাচোখি, তৃতীয় দিন তানভির বলল,
— “দেখো, আমরা ঝগড়া করতেই পারি, কিন্তু একসাথে কাজ না করলে হারব।”
তৃষা একটু ভেবে বলল,
— “ঠিক বলেছো। চল, কাজটা আগে করি। ঝগড়া পরে করব।”
এভাবেই আস্তে আস্তে তৈরি হতে লাগল একটা বন্ধুত্বের প্রথম সেতু।
চতুর্থ দিন তানভির বলল,
— “তোমার যুক্তিগুলো দারুন ছিল, তুমি খুব গুছিয়ে কথা বলো।”
তৃষা একটু চমকে তাকিয়ে বলল,
— “তুমি এটা বললে? তানভির? যাকে আমি সবচেয়ে রাগী ছেলে বলে জানতাম?”
তানভির হেসে বলল,
— “হয়তো সব সময় রাগ করে থাকলেও, মাঝে মাঝে ভালো কিছু বলতেও মন চায়।”
তৃষার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।
প্রতিযোগিতার দিন তারা যেন একটা টিমে নয়, একটা আত্মা হয়ে উঠেছিল। কথায় কথায় তাদের যুক্তি শ্রোতাদের মোহিত করে ফেলেছিল। বিচারকরা প্রশংসা করলেন তাদের একসাথে কাজ করার দক্ষতা দেখে।
চূড়ান্ত রেজাল্ট ঘোষণার সময় মঞ্চে দাঁড়িয়ে তানভির হঠাৎ বলল,
— “তৃষা, আজ তুই না থাকলে আমরা জিততাম না।”
তৃষার চোখে এক ঝিলিক উচ্ছ্বাস,
— “তুই বলছিস! অবিশ্বাস্য!”
— “অভ্যাস করে ফেল।”
সেই দিন থেকেই বদলে গেলো সবকিছু। প্রতিদিন স্কুলে দেখা, আড্ডা, লাঞ্চ ভাগাভাগি করে খাওয়া। মাঝে মাঝে ঝগড়া করত ঠিকই, কিন্তু সেটা এখন মিষ্টি ঝগড়া।
একদিন ক্লাস শেষে হঠাৎ বৃষ্টি নেমে গেল। সবাই দৌড়ে ছাতা খুঁজতে ব্যস্ত। তানভির ছাতা নিয়ে তৃষার পাশে এসে দাঁড়াল।
— “ভিজে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি, চল একসাথে যাই।”
তৃষা একটু থেমে বলল,
— “তুই তাহলে আমার দিকে একটু একটু করে নরম হয়ে যাচ্ছিস, তাই না?”
— “হয়তো... বা তোকে সহ্য করার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।”
তৃষা তাকিয়ে রইল। মুখে কিছু বলল না, কিন্তু মনে মনে একটা অজানা আবেগ খেলে গেল।
তাদের মধ্যে আর আগের সেই বিদ্বেষ নেই। আজ তারা বন্ধু—সত্যিকারের বন্ধু।
তবে যা কেউ জানে না, এমনকি তানভির নিজেও নয়—তার বুকের ভেতরে ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত টান জন্ম নিচ্ছে, যেটা বন্ধুত্বের গণ্ডি ছাপিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
বন্ধুত্বের একটা অদ্ভুত দিক আছে। কখন যে সেটা ভালোবাসায় রূপ নেয়, তা কেউ টেরই পায় না। তানভির আর তৃষার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই-ই হলো।
দিনগুলো এগোতে লাগল। স্কুলের প্রতিটি ঘণ্টা যেন তাদের বন্ধুত্বের নতুন অধ্যায় খুলে দিচ্ছিল। একসাথে আসা, একসাথে যাওয়া, টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া, ক্লাসের ফাঁকে ফিসফিস করে গল্প করা—সবটাই এক মায়াময় অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল।
একদিন দুপুরে ক্লাসে পড়া হচ্ছিল না। সবাই ফাঁকা ফাঁকা বসে। তানভির আর তৃষা তখন জানালার পাশে বসে গল্প করছে।
তৃষা হঠাৎ বলল,
— “তুই জানিস? তোকে আমি প্রথমে একদম সহ্য করতে পারতাম না!”
তানভির হেসে বলল,
— “এটা তো আমিও জানি! প্রথম দিনই তো বলতে চেয়েছিলি, ‘এই বেঞ্চটা আমার!’”
তৃষা চোখ বড় করে বলে উঠল,
— “আরে! সত্যিই তো! আর তুই কি বলেছিলি মনে আছে?”
— “স্কুল কি তোমার বাপের নাকি?”
দুজনেই হেসে লুটিয়ে পড়ল।
এই হাসির মধ্যেই ছিল এক ধরনের নির্ভরতা, এক ধরনের মায়া—যেটা আর শুধু বন্ধুত্বে আটকে ছিল না, অন্তত তানভিরের মনে।
সেই দিন বিকেলে তানভির বাসায় ফিরেও অদ্ভুত একটা অনুভব থেকে মুক্ত হতে পারল না। সে চুপচাপ বসে ছিল, বইখাতা সামনে, কিন্তু মন ছিল না। হঠাৎ তার মা এসে বললেন,
— “তোর চোখে কী যেন বলছিস রে তানভি! কিছু হয়েছে?”
তানভির ধীর গলায় বলল,
— “জানি না মা, কেমন যেন লাগছে... বুঝতে পারছি না কেন!”
সেই রাতেই তানভির বালিশের নিচে রেখে দিল তার ডায়েরি। ডায়েরির পৃষ্ঠায় আজ লেখা হলো:
“ওর হাসিটা আজও চোখের সামনে ভাসছে...
ও যখন আঙুল তুলে হাসে, মনে হয় এই হাসিটাই আমার দুনিয়া।
আমি কি তৃষাকে... ভালোবেসে ফেলেছি?”
এরপর থেকে তানভির বুঝতে লাগল, সে প্রতিটা মুহূর্ত তৃষার চিন্তায় ডুবে থাকে। স্কুলে গেলে তাকিয়ে থাকে কখন ও আসবে। না আসলে অস্থির হয়ে পড়ে।
একদিন তৃষা স্কুলে আসেনি। কোনো খবর নেই। মেসেজ দিলে রিপ্লাই নেই। কল দিলেও ধরছে না। পুরো দিনটাই তানভিরের কাছে অন্ধকার হয়ে গেল।
সন্ধ্যায় রাফি তানভিরকে জিজ্ঞেস করল,
— “দোস্ত, তুই এত চুপচাপ কেন?”
তানভির চোখ নামিয়ে বলল,
— “তৃষা আসে নাই রে... কেমন জানি অশান্ত লাগছে।”
রাফি ঠোঁটে একটুখানি স্মিত হাসি এনে বলল,
— “তুই প্রেমে পড়ছিস রে ভাই।”
তানভির কোনো জবাব দিল না। শুধু মাথা নিচু করে বসে রইল। মনে মনে শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল—
“আমি কি সত্যিই ওকে ছাড়া থাকতে পারি না?”
এরপর কয়েকদিন তৃষা আসেনি। তানভির রাতে ঘুমাতে পারত না। একদিন ডায়েরির পেছনে একটা কবিতা লিখল:
"তুই না থাকলে মনে হয়—
চারপাশের শব্দগুলোও থেমে যায়,
বুকের ভেতর একটা শূন্যতা জমে ওঠে,
আর সময়টা থমকে দাঁড়ায়।"
এভাবেই চলছিল তানভিরের দিনরাত্রি।
তৃষা অবশেষে একদিন স্কুলে এল। হাঁটতে হাঁটতে ক্লাসে ঢুকল। চেহারায় ক্লান্তি, চোখে একটু অস্থিরতা।
তানভির ধীরে এসে জিজ্ঞেস করল,
— “তুই ঠিক আছিস?”
তৃষা একটু চুপ থেকে বলল,
— “বাসায় কিছু সমস্যা... তাই আসতে পারছিলাম না। তুই কেমন আছিস?”
তানভির কোনো উত্তর দিল না। শুধু বলল,
— “তুই আসছিস, এটাই অনেক।”
তৃষা একটু অবাক হয়ে তাকাল। তানভির চোখ নামিয়ে নিল, যেন কিছু চেপে রাখছে।
সেদিন সন্ধ্যায় সে আবার ডায়েরি লিখল।
"আজ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝলাম—আমি ওকে শুধু বন্ধু হিসেবে দেখি না। ও আমার সবকিছু। আমার সকাল, আমার রাত... আমার অনুভব। আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি।"
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে।
তানভির আর তৃষার বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে। কিন্তু তানভির জানে, তার অনুভব এখন আর বন্ধুত্বের গণ্ডিতে আটকে নেই।
সে বুঝে গেছে—সে তৃষাকে ভালোবাসে।
প্রাণপণে। নিঃশর্তভাবে।
তৃষা এখনো জানে না কিছুই।
তার চোখে তানভির এখনো শুধু একজন আপন বন্ধু, যার সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করা যায়, নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায়।
একদিন ছুটির পরে স্কুলের পেছনের বাগানে, ছায়া-ঘেরা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল তানভির।
হাতে একটা ছোট্ট চিরকুট।
চোখে কাঁপুনি, ঠোঁটে দ্বিধা।
তৃষা আসছে।
— “তৃষা, একটু দাঁড়া... তোকে কিছু বলার আছে।”
— “হ্যাঁ? কী বলবি?”
— “তুই জানিস, আমরা কতদিন ধরে বন্ধু? কত কিছু শেয়ার করি... ঝগড়া, হাসি, গল্প, স্বপ্ন... কিন্তু…”
তানভির থেমে গেল। গলা কেঁপে উঠছে।
তৃষা বলল,
— “হ্যাঁ? কিন্তু কী?”
তানভির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আমি তোকে ভালোবাসি তৃষা। খুব বেশি। তোকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারি না।”
তৃষা যেন মুহূর্তেই জমে গেল।
চোখ বড় হয়ে তাকিয়ে রইল তানভিরের দিকে।
— “তুই... তুই কী বললি?”
— “হ্যাঁ তৃষা, আমি তোকে ভালোবাসি। অনেকদিন ধরে... কিন্তু বলতে পারছিলাম না।”
তৃষা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলল,
— “তুই কি পাগল হয়ে গেছিস তানভির? আমরা তো শুধুই বন্ধু! তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু! আমি তোকে কখনো ওই চোখে দেখিনি!”
তানভির মাথা নিচু করে বলল,
— “আমার অনুভবটা আটকে রাখতে পারিনি তৃষা... তোকে বলতেই হলো।”
তৃষা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
— “তুই তো আমাদের বন্ধুত্বটাই শেষ করে দিলি! আমি তোকে বিশ্বাস করতাম... তুই সেটা ভেঙে দিলি!”
তানভির চুপ। চোখে জল জমে আছে।
তৃষা হঠাৎ তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
— “আজকের পর থেকে আর কখনো আমার সামনে আসবি না। Never!”
তৃষা চলে গেল। তার চোখেও জল ছিল। কিন্তু সে সেটা দেখাতে চাইল না।
তানভির বসে পড়ল মাটিতে। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো।
সে জানত না ভালোবাসার স্বীকারোক্তি এতটা ভাঙন এনে দিতে পারে।
পরবর্তী দিনগুলোতে তৃষা তার সাথে একটুও কথা বলল না।
ক্লাসে এলে তাকাত না, চোখে চোখ পড়লেই মুখ ঘুরিয়ে নিত।
তানভির তাও প্রতিদিন এক কোণায় বসে থাকত, চুপচাপ।
সে রোজ রাতে ডায়েরি লিখত, রক্ত দিয়ে তৃষার নাম লিখত।
"তৃষা, তোকে কষ্ট দিয়েছি ঠিকই…
কিন্তু তোর প্রতি আমার ভালোবাসা কোনো খেলার মতো নয়।
এটা আমার নিঃশেষ ভালোবাসা।
তুই আমাকে ঘৃণা করলেও, আমি তোকে ভালোবেসেই যাবো।"
সে একটা একটা করে চিঠি লিখতে শুরু করল।
প্রতিটা চিঠিতে নিজের ভালোবাসা, কষ্ট, বেদনা ঢেলে দিত।
তৃষার নাম রক্ত দিয়ে লিখে রাখত।
কিন্তু কোনো চিঠিই দেয়নি। সেগুলো জমা হতে লাগল তার বইয়ের খাতার ভাঁজে, পুরোনো নোটবুকে, ডায়েরির পেছনে।
রাফি একদিন বলল,
— “তুই তো একদম পাল্টে গেছিস দোস্ত। পড়াশোনা করিস না, হাসিস না... তৃষা তো তোকে ফিরেও দেখে না।”
তানভির শুধু বলল,
— “ভালোবাসা মানে দখল নয়, রাফি। ওর মুখে না শুনেও আমি আজীবন ওর হয়ে থাকতে পারি। শুধু চাই ও সুখী থাকুক।”
রাফি স্তব্ধ হয়ে গেল। এত গভীর ভালোবাসা সে কখনো চোখে দেখেনি।
দিন যায়...
তৃষা সব ভুলে থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু কোথাও একটা খচখচানি কাজ করে।
তানভিরের মুখ, তার কষ্ট, তার চোখের কান্না... কিছুই যেন ভুলতে পারছে না।
হঠাৎই তার মনে হতে লাগল—তানভির কি সত্যিই তাকে এতটা ভালোবাসে?
কিন্তু সে তখনও জানত না—তানভিরের সেই রক্তমাখা চিঠিগুলো একদিন তাকে নাড়িয়ে দেবে ভেতর থেকে।
চল তবে এবার যাই গল্পের সবচেয়ে আবেগঘন এক পর্বে—
যেখানে ভালোবাসা শুধু অনুভব নয়, একান্ত স্বীকারোক্তি হয়ে তৃষার সামনে ধরা দেবে।
এটা সেই মুহূর্ত, যেটা গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
সময় চলে যায়।
পৃথিবী থেমে থাকে না।
তৃষা আর তানভিরের মাঝে একরাশ নীরবতা, একধরনের ভাঙা বিশ্বাসের দেয়াল দাঁড়িয়ে গেছে।
তৃষা যেন নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলেছে। পড়াশোনা, পরিবার, বন্ধুদের আড্ডা—সবকিছুতে সে নিজেকে মিশিয়ে দেয়, যাতে একটা নাম মনের ভেতর না ঘুরে ফিরে আসে।
তানভির এখন আগের মতো স্কুলেও ঠিকমতো আসে না। আসলেও কারো সঙ্গে কথা বলে না।
চোখে কেবল ক্লান্তি, ভেতরে গভীর এক শূন্যতা।
তার বন্ধু রাফি মাঝে মাঝে জোর করে নিয়ে আসে স্কুলে,
— “চল দোস্ত, একদিন না থাকলে চলে যাবে জীবন থেকে? তোকে দেখে তো রোবট মনে হয়।”
তানভির শুধু ছোট করে হাসে,
— “রোবটও হয়তো কাঁদে... শুধু কেউ দেখে না।”
তৃষার জীবনে পরিবর্তন আসে হঠাৎ এক দুপুরে।
অল্প বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। হালকা গরম, মেঘলা আকাশ।
সে দিন তৃষা স্কুলে আসেনি।
রাফি, তানভিরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল, সবকিছুই সে জানে।
সে তানভিরের ব্যাগ থেকে বই নিতে গিয়ে দেখে একটা ডায়েরিতে রক্তমাখা পাতাগুলো রাখা।
তানভির তখন ক্লাস রুমের জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে।
রাফি সেগুলা দেখে চুপ চাপ বসে থাকতে পারে না। সে ভাবে—
"তৃষা যদি জানত, এই ছেলে ওকে কতটা ভালোবাসে, তাহলে কি ও কখনো এমন করত?"
সেই চিন্তা থেকেই রাফি ডায়েরিটা তানভীরের ব্যাগ থেকে নিয়ে যায়। স্কুল ছুটির পর রাফি তৃষার বাসার সামনে যাই। তৃষার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দ্বিধায় থাকে।
শেষে সাহস করে দরজায় কড়া নাড়ে। তৃষা নিজেই দরজা খোলে।
— “তৃষা… এটা নাও অনেক কিছু পাবে তুমি।”
এই বলে রাফি চুপচাপ ডায়েরিটা দিয়ে দিয়ে চলে যায়।
তৃষা তখন জানত না, তার জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন অধ্যায়টা ওই পাতাগুলোর ভাঁজেই লুকিয়ে আছে...
তখন তৃষার মা তাকে ডাকে,
— আসছি মা..
সে তখন ডাইরিটা নিজের বই খাতার নিচে রেখে চলে যাই,এবং কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। ডাইরিটা দেখার কথা ভুলে গেছিলো,ওভাবেই ডাইরিটা চাপা পড়ে আছে ডাইরিটা।
এক দিন তৃষা বাসায় খাতা বই গুছাচ্ছিল। তখন সেই ডাইরিটা টেবিল থেকে নিচে পড়ে যাই। পড়ন্ত ডাইরিটা তুলতে গিয়ে একখানা ভাঁজ করা পৃষ্ঠার ওপর তার চোখ পড়ে।
—লাল কালি, না রক্ত?
সে কৌতূহল নিয়ে পৃষ্ঠা খুলে দেখে—
“তৃষা”—রক্তে লেখা নাম।
তৃষা স্তব্ধ হয়ে যায়।
আরেকটা চিঠি, তারপর আরেকটা…
একটার পর একটা হাত কাঁপিয়ে ভাঁজ খুলে পড়ে সে।
সবগুলোতে একটাই অনুভব—
ভালোবাসা, ব্যথা, কান্না, অপেক্ষা।
চিঠিগুলোর ভিতর ছিলো রক্ত দিয়ে লেখা তার নাম, চিঠির ভাষা ছিল নির্জলা ভালোবাসার।
একটা চিঠিতে লেখা ছিল:
“তুই হয়তো আর কোনোদিন আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলবি না,
কিন্তু তুই আজীবন আমার হৃদয়ের ভেতর কথা বলবি।
তুই জানিস না, তোর একটা না-ভালো থাকা মানে আমার অন্ধকারে ডুবে যাওয়া।
রক্ত দিয়ে লিখেছি তোকে, কারণ কলম দিয়ে তো তুই বিশ্বাস করিস না…”
তৃষার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
তার বুকের ভিতরটা ধকধক করে ওঠে।
চোখের জল গড়িয়ে পড়ে তার হাতে ধরা চিঠির উপর।
সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে।
হঠাৎ তার মনে পড়ে—তানভির কেমন কাঁদছিল, সেদিন তার চোখে ছিল যন্ত্রণার রং।
সে কি আসলেই এতটা ভালোবাসে তাকে?
তার ভেতরটা একরকম ঘূর্ণির মতো ঘুরে যেতে থাকে।
যাকে সে “শুধু বন্ধু” ভেবেছিল, সেই বন্ধুতার আড়ালে যে ভালোবাসার গভীরতা লুকিয়ে ছিল, সে তো বোঝেইনি!
তৃষা চিঠিগুলো নিজের বুকে চেপে ধরে বলে উঠল—
— “তুই তো পাগল! তোকে এতোটা ভালোবাসি আমি বুঝতেই পারিনি...”
পরদিন সকালে স্কুলে ঢোকার আগেই সে ছুটে যায় ক্লাসের পেছনের ছোট্ট বেঞ্চটার দিকে—যেখানে একসময় ওরা একসাথে বসত।
সেখানে একা বসে আছে তানভির। একদম নিস্তব্ধ, পেছন ফিরে আছে।
তৃষা ছুটে গিয়ে তার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে—
— “তানভির... তুই আমাকে এমন ভালোবাসিস কেন রে?”
তানভির ঘুরে তাকায়, চোখে বিস্ময় আর অশ্রু।
তৃষা তার চোখে চোখ রেখে কাঁপা গলায় বলে,
— “আমি পাগল! তোর অনুভব বুঝতে পারিনি। তোকে শুধু বন্ধু ভেবে কত অন্যায় করে বসেছি! আমাকে মাফ করে দে... আমি তোকে ভালোবাসি... সত্যি ভালোবাসি...”
তানভির কিছু বলতে পারে না। শুধু দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
সে তৃষাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে—
— “তুই শুধু আমার… তুই শুধু আমার হবি, আজীবন…”
দূরে স্কুলের ঘণ্টা বেজে ওঠে।
শুরু হয় একটা নতুন ক্লাস—নতুন এক জীবনপাঠের।
...................
Facebook page সোনাবিদ কাব্য
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন