সোনাবিদ কাব্য – কবিতা, ভালোবাসা আর জীবনের গভীর অনুভূতির এক অনন্য ভুবন। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া প্রেম, বিরহ, সুখ-দুঃখের কবিতাগুলো পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ব্লগ।

Responsive Advertisement

শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

ভাঙা দালানের ছায়া


                                              Facebook page

ভাঙা দালানের ছায়া

পর্ব ১: আগমন

শরৎকাল। বিকেলের আলো ঝিমিয়ে আসছে। গাছের পাতায় হালকা রোদ খেলে যাচ্ছে।
আদিত্য, এক তরুণ লেখক, শহরের কোলাহল থেকে দূরে এক নিরিবিলি গ্রামে আসে কিছুদিনের জন্য।
শান্ত পরিবেশ, নির্জনতা—সব কিছু লেখার জন্য আদর্শ মনে হয়েছিল।

গ্রামের নাম চণ্ডীপুর
লোকসংখ্যা কম, কিন্তু গাছগাছালি আর প্রাকৃতিক দৃশ্য মন ভালো করে দেয়।
আদিত্য একটা পুরনো, পরিত্যক্ত বাড়ি ভাড়া নেয়—বাড়িটার স্থানীয় নাম “ঠাকুরবাড়ি”
শোনা যায়, অনেক বছর আগে এক জমিদার পরিবার এখানে বাস করত।
কেউ জানে না হঠাৎ করেই তারা কীভাবে উধাও হয়ে গেল।
লোকজন বলে, সেই বাড়ি ‘অভিশপ্ত’।
কিন্তু আদিত্য এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না।

প্রথম দিন রাতে, সব কিছু ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নেয় সে।
চারপাশে নীরবতা, শুধু মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক।
হঠাৎই রাত ২টা নাগাদ দরজার কাছে হালকা একটা শব্দ হয়—“ঠক ঠক…”
আদিত্য দরজা খোলে, কেউ নেই।
ভাবল, বাতাসে হয়তো দরজা নড়েছে।

পরদিন গ্রামের এক বৃদ্ধ গদাধর কাকা আদিত্যকে বলেন,
“এই বাড়িতে কিছু একটা আছে বাবু… রাত তিনটার সময় যদি কারো কান্নার শব্দ শোনো, বাইরে যেও না।”

আদিত্য হাসল, “বুড়ো মানুষ, গল্প বানায়।”
তবে মনটার ভেতর একটু কাঁপুনি যেন জেগে উঠল।

রাত তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট।
আদিত্য লেখায় ব্যস্ত। হঠাৎই একটা কান্নার শব্দ… খুব ধীরে ধীরে বাড়ছে।
নারী কণ্ঠ, যেন দূর থেকে ভেসে আসছে…

সে উঠে দাঁড়ায়। কানটা দরজার কাছে নেয়।
আবার সেই শব্দ…
একটা মেয়ে কাঁদছে, অঝোরে।

আর ঠিক তখনই—
পেছনে হালকা হাওয়ার মতো কিছু একটা তার ঘাড় ছুঁয়ে যায়…
ঠান্ডা শ্বাস, যেন কেউ তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে…



পর্ব ২: অদৃশ্য ছায়ার পদচিহ্ন

পেছনে কারও ঠান্ডা শ্বাসের স্পর্শ টের পেয়ে মুহূর্তে কেঁপে ওঠে আদিত্য।
দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় সে। কেউ নেই।
ঘরের বাতি টিমটিম করছে। দেয়ালের কোণে হঠাৎ দাগ পড়ে গেছে, যা আগেও ছিল না—
চোখের সামনে কেমন একটা ছায়া লেগে আছে… অস্পষ্ট, কিন্তু অনুভব করা যায়।

সেই রাতটা আর ঘুমাতে পারেনি সে। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে বসে ছিল একটানা।
সকালে চোখ লাল, ক্লান্ত মুখ।
গ্রামের চায়ের দোকানে গিয়ে বসে, আর সেই গদাধর কাকাকে দেখে ডাক দেয়।

“কাকা, সত্যি কি এই বাড়িতে কিছু আছে?”
বৃদ্ধ মুখটা নিঃশব্দে চা চুমুক দেয়। তারপর বলল—
“তুই বিশ্বাস করিস নাকি?”
“আগে করতাম না। এখন… মনে হচ্ছে কিছু একটা আছে।”

গদাধর কাকা নিচু স্বরে বলতে শুরু করলেন—
“এই বাড়ি এককালে জমিদার শশাঙ্ক রায়ের ছিল।
তাঁর একমাত্র মেয়ে ছিল—রূপা।
রূপার সাথে এক গরীব পত্র লেখকের প্রেম হয়। শশাঙ্ক রায় তা সহ্য করতে পারেননি।
বিয়ের আগের দিন রাতে সেই ছেলেটাকে খুন করা হয়।
রূপা আর কোনোদিন কথা বলেনি।
শেষ রাতেই সে নিজেকে এই বাড়ির দালানের ঘরে ফাঁসি দেয়।
তারপর থেকেই কেউ এখানে থাকতে পারে না।
যে-ই রাতে ৩টার দিকে কান্না শুনেছে, তার মনোজগতে কিছু না কিছু ক্ষয় শুরু হয়েছে।”

আদিত্য চুপ করে শুনছিল। গায়ে হালকা শীত বয়ে যাচ্ছিল, যদিও রোদ ছিল চারপাশে।
সে রাতে লেখার সময় হঠাৎ টেবিলের খাতার ওপর পানি পড়ে গেল।
খাতা সরাতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা পুরনো হলদে কাগজ…
কোনো চিঠির টুকরো।
তাতে লেখা—

"তুমি না এলে আমি একাই চলবো অন্ধকার পথে।
তোমার ছায়া যদি ফিরে আসে, জানবে আমি এখনও অপেক্ষা করছি… রূপা"

আদিত্য হতভম্ব। সে এই চিঠি কখনও লেখেনি।
তবে এই কাগজ এল কোত্থেকে?

সে ঘর তল্লাশি শুরু করে দেয়।
দেয়ালের পেছনে চাপা একটা সিঁড়ি আবিষ্কার করে।
সিঁড়িটা উঠে গেছে দোতলার এক বন্ধ ঘরে।
জংধরা দরজা, তালা ভাঙা, ভেতরে শুধু ধুলো আর বাতাস।

কিন্তু ঘরের কোণায় রাখা একটা আয়নায় হঠাৎ সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায় না!
আয়নাটায় অন্য একটা ছবি—এক মেয়ের মুখ… চোখে জল, ঠোঁটে চাপা হাসি…

হঠাৎ দরজা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়।
আদিত্য দরজা ঠেলে খোলার চেষ্টা করে। কোনো লাভ নেই।

আর ঠিক তখনই আয়নার ভেতরের মেয়ে ধীরে ধীরে তার দিকে ঘুরে তাকায়…
তার চোখদুটো যেন আগুনের মতো লাল, মুখে এক অদ্ভুত রাগ আর যন্ত্রণা!

আর বাইরে থেকে ভেসে আসে সেই একই করুণ কণ্ঠস্বর—
“তুমি কেন এসেছো... আবারও কি আমায় ছেড়ে যাবে?”

আদিত্য আতঙ্কে কাঁপতে থাকে…
আর আয়নার সামনে পড়ে থাকা চিঠির নিচে রক্তের দাগ ফোঁটায় ফোঁটায় জমে উঠতে থাকে…


পর্ব ৩: ছায়ার প্রেম আর প্রতিশোধ

ঘরের দরজা বন্ধ, আয়নার ভেতর থেকে লাল চোখে তাকিয়ে আছে সেই অজানা মেয়ে।
আদিত্য পিছিয়ে আসে, হাওয়ায় কাপছে খোলা জানালার পর্দা, আর তার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠছে।

একটু পরেই—
আয়নার মেয়ে ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায়।
দরজাটা "ক্রীচ" শব্দ করে আপনিই খুলে যায়।
আদিত্য দৌড়ে নিচে নামে। দরজা খুলে বাইরে এসে হাঁপাতে থাকে।

কিন্তু এবার সে পালাতে চায় না।
সে জানে—এ বাড়িতে কিছু একটা আছে,
আর সেটার সঙ্গে তার নিজের কোনো যোগ আছে… কোনো অজানা সম্পর্ক।

পরদিন সকালে সে খোঁজ নেয় গ্রামের পুরনো রেকর্ড ঘরে।
পাঁচটা ধুলো ধরা নথি খুঁজতে খুঁজতে একসময় একটা ফাইল পায়—
“শশাঙ্ক রায় ও কন্যা রূপা – পরিবার ইতিহাস”

ফাইলের এক পাতায় কিছু কবিতা লেখা ছিল।
তার নিচে লেখা নাম: অরুণাভ সেন।

আদিত্য থমকে যায়।
এই নামটা তার দাদুর।

তার মনে পড়ে, ছোটবেলায় সে শুনেছিল—
তার দাদু একসময় একজন কবি ছিলেন, হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান।
সেই সময়টা মিলছে এই চণ্ডীপুরের ঘটনার সময়ের সঙ্গে!

তার মানে…
রূপা যে লেখককে ভালোবাসতো, সে ছিল আদিত্যর দাদু!

এই সত্য জানার পর আদিত্যর শরীর কাঁপতে থাকে।
সে ভাবে, হয়তো এই আত্মা শান্তি পায়নি বলেই তার টান তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

রাতে সে আবার সেই ঘরে যায়।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে—
“তুমি কি রূপা?”

আয়নার ভেতর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সেই মেয়েটির মুখ। এবার সে চুপচাপ কাঁদছে।
তার ঠোঁট কাঁপছে—
“তুমি ফিরে এসেছো... অরুণাভ!”

আদিত্য বলে, “আমি অরুণাভ না। আমি তার নাতি… আদিত্য।”
রূপা কাঁদতে কাঁদতে বলে—
“তুমি তার মতোই লিখো… আমি চিঠি দিয়েছিলাম… আমি প্রতীক্ষা করেছিলাম… আর শেষে...”

সে হঠাৎ বদলে যায়। গলার স্বর রুক্ষ হয়ে ওঠে, চোখ আবার লাল।

“তোমাদের পরিবার আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে…
তোমাদের কেউই মুক্তি পাবে না…
তুমিও না।”

দেয়াল কেঁপে ওঠে, ঘরের বাতি জ্বলে-নিভে।
আদিত্য বুঝে যায়—এ কেবল প্রেমের গল্প না, এটা প্রতিশোধের আগুন…

আর এই আগুন তার নিজের রক্তেও ছড়িয়ে পড়েছে…


পর্ব ৪: চিঠির আগুন, ছায়ার মুক্তি

রূপার আত্মা যে কেবল অপেক্ষা করেনি, বরং অভিমানে, ক্ষোভে, প্রতিশোধে পুড়েছে, তা এখন স্পষ্ট।
আদিত্য জানে, তাকে এখান থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু পালিয়ে গেলেই চলবে না—
তাকে এই আত্মার সঙ্গে তার দাদু অরুণাভ সেনের অসমাপ্ত প্রেমের শেষ অধ্যায়টা লিখে দিতে হবে।

সে রাতে চাঁদের আলোয় আকাশ ফাঁকা ছিল, কিন্তু ঠাকুরবাড়ির চারপাশে এক অদ্ভুত শীতলতা নামছিল।
আদিত্য রূপার পুরনো চিঠি আর তার দাদুর পুরনো কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসে।
সে জানে, তাকে কিছু একটা লিখতেই হবে।
সে লিখতে শুরু করে—একটা চিঠি, অরুণাভের পক্ষ থেকে।


“রূপা,
আমি জানি, তুমি আমাকে খুঁজে ফিরেছো এই অসীম অপেক্ষার ভিতর দিয়ে।
আমার কলম থেমে গেছিল, কিন্তু ভালোবাসা থেমে যায়নি।
আমার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মানুষের হিংসা, কিন্তু আত্মা এখনো তোমার চরণে পড়ে আছে।
তুমি মুক্ত হও রূপা, তুমি এই পৃথিবীর প্রতিশোধ আর কান্না থেকে বেরিয়ে এসো।
তোমার প্রেম বিশুদ্ধ ছিল, সেই বিশুদ্ধতার জন্যই আমি তোমার কাছে মাথা নুইয়ে ক্ষমা চাইছি—
আমি অরুণাভ।"


চিঠিটা সে ভাঁজ করে রেখে দেয় সেই আয়নার সামনে।
এবার কিছুই ঘটে না। নীরবতা… নিস্তব্ধতা।

হঠাৎ আয়নাটা কাঁপতে থাকে।
আলো নিভে যায়। দেয়াল থেকে একটা ছায়া বেরিয়ে আসে—
সে ধীরে ধীরে রূপা হয়ে ওঠে।
তার চোখে জল, কিন্তু এবার আর আগের মতো ভয় নেই।

সে চুপচাপ চিঠিটা হাতে নেয়। পড়তে থাকে…

তার ঠোঁটে আস্তে একটা হাসি আসে।
সে বলে—
"শেষবারের মতো, আমি তাকে ক্ষমা করলাম।
আমি মুক্ত, আদিত্য। তুমি এসেছো বলেই পারলাম।"

তার দেহ থেকে ধোঁয়ার মতো ছায়া উঠে যেতে থাকে—
একটা সাদা আলো তাকে ঘিরে ফেলে।
সে ভেসে ওঠে বাতাসে…
আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।

পরদিন সকালে আদিত্য বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায়।
বাড়িটা আর আগের মতো ভীতিকর মনে হয় না।
দোতলার জানালায় একটা ফাঁকা আয়না ঝকঝকে রোদে ঝলমল করে।

গদাধর কাকা এসে বলে—
“তুই বুঝি… তাকে মুক্ত করে দিয়েছিস?”

আদিত্য চুপচাপ মাথা নাড়ে।
সে জানে, সে কেবল একটি আত্মাকে শান্তি দেয়নি,
একটি ভালোবাসাকে পূর্ণ করেছে—যেটা শত বছর অপেক্ষা করেছিল।

তবে…
একটা বিষয় সে কাউকে বলেনি—

সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে সে নিজের ডেস্কে একটা কাগজ দেখতে পায়।
তাতে লেখা:

“আদিত্য, তোমার কলমের ছোঁয়ায় আমি মুক্তি পেলাম।
কিন্তু একদিন, যদি প্রেম অসমাপ্ত থাকে, আমি আবার ফিরে আসব…
এক ছায়া হয়ে…”

চিঠিটা রক্তের দাগে শেষ হয়েছিল।


[শেষ]

ভাঙা দালানের ছায়া – এক অপূর্ণ প্রেম, এক ভয়াল প্রতিশোধ আর এক লেখকের কলমে লেখা ইতিহাস।



কোন মন্তব্য নেই:

Subscribe Us

Main Slider

SoraBook

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Vestibulum rhoncus vehicula tortor, vel cursus elit. Donec nec nisl felis. Pellentesque ultrices sem sit amet eros interdum, id elementum nisi ermentum.Vestibulum rhoncus vehicula tortor, vel cursus elit. Donec nec nisl felis. Pellentesque ultrices sem sit amet eros interdum, id elementum nisi fermentum.




Comments

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *