নিঃস্বার্থ প্রেম – শেষ পর্ব
শুভর জীবনে অনেক দিন কেটে গেছে অরণির মৃত্যুর পর। "অরণি বিদ্যানিকেতন" স্কুলটি আজ অনেক বড় হয়ে উঠেছে, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। শুভ তার কাজের সঙ্গে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, প্রায়ই রাতের পর রাত একা বসে স্কুলের রিপোর্ট দেখতে হয়, স্কুলের ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করতে হয়।
কিন্তু তার হৃদয়ের কোণে, সে জানতো—এইসব কিছুই একা করে সে অরণির স্মৃতিকে সম্মান জানাতে চায়।
এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা
একদিন, শুভ স্কুলে বসে কাজ করছিল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনল।
—"কী ব্যাপার, এসো।"
দরজা খুলে এক পরিচিত মুখ দেখলো শুভ। সেই মুখ—তিন বছর আগে যাকে সে শেষবার দেখেছিল, আজ সেই তার সামনে দাঁড়িয়ে।
অরণির ছোটবেলার বন্ধু, শোভা।
—"শোভা! তুমিই?" শুভ চমকে উঠল।
—"হ্যাঁ, শুভ। দীর্ঘদিন পর দেখা। তুমি তো অনেক বদলে গেছ।"
শুভ হাসল, কিন্তু তার চোখে বিষণ্ণতা ছিল।
—"কেমন আছো, শোভা?"
—"ভালো আছি, তবে জানো, অরণির জন্য অনেক কিছু বলার ছিল। তুমি জানো না, সে সবসময় তোমার কথা ভাবতো।"
শুভ চুপ করে রইল। তার গলা কিছুটা ভারী হয়ে উঠেছিল।
—"আসলে, তোমার জন্য আমার কিছু ছিল। অরণি যে ডায়েরি রেখে গেছে, সেটাও তুমি জানো না, শুভ।" শোভা একটি পুরনো খামে কিছু কাগজ বের করল। "এই ডায়েরি অরণির শেষ দিনের লেখা। সে ঠিক করেছে, তোমার জন্য একটি উপহার রেখে যাবে, যাতে তুমি তার ভালোবাসাকে একদিন ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারো।"
শুভ অবাক হয়ে ডায়েরিটা হাতে নিল। খামের ভেতরে দুটি চিঠি ছিল। একটির ওপর লেখা ছিল: "শুভ, আমি জানি, তুমিই আমার জীবনের একমাত্র ভালোবাসা ছিলে, কিন্তু তুমি কখনো সেটি বুঝতে পারবে না। তবুও, তোমাকে আমি এই পৃথিবীতে চিরকাল ভালোবাসি।"
আরেকটি চিঠির মধ্যে ছিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা, যা অরণি শুভকে বলতে চেয়েছিল:
"শুভ, আমি তোকে চাইনি নিজের জন্য, আমি চাইছিলাম তোর সুখের জন্য। জানি, তুই আমাকে কখনো ভালোবাসবে না, কিন্তু তোর ভালোবাসা ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।"
আবেগের ফাঁদ
শুভ যখন চিঠি দুটি পড়ল, তখন তার চোখের কোণে জল চলে এল। এত বছর পর, এত তিক্ত সত্যের মুখোমুখি হয়ে সে বুঝতে পারলো, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল অরণিকে কখনো নিজের অনুভূতি না জানানো।
এটি ছিল তার জীবনের একমাত্র সুযোগ—একটি অপ্রত্যাশিত উপহার, এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের স্নেহভরা অভিবাদন।
যতটা দেরিতে হোক, শুভ জানতো যে, একদিন সে অরণির ভালোবাসাকে পুরোপুরি বুঝতে পারবে। কিন্তু সেটা আর সে কখনো অরণির কাছে বলতে পারবে না।
শুভ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর সিদ্ধান্ত নিল—এবার তার জীবন নতুনভাবে শুরু করতে হবে, শুধু তার নয়, অরণির জন্যও।
এক নতুন শুরু
শুভ এখন "অরণি বিদ্যানিকেতন" স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আজ আর আগের মতো স্বপ্নের পিছনে ছুটে যাওয়া নয়, তার এখন একমাত্র লক্ষ্য—অরণির ভালোবাসার আদর্শকে অনুসরণ করা, সে যা চেয়েছিল তা সত্যি করা। স্কুলে শিখানো নয় শুধু, শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে ভালোবাসার গুরুত্ব স্থাপন করা—এটাই ছিল তার নতুন লক্ষ্য।
আর কিছু বছর পর, শুভ নিজেও পরিবার নিয়ে এক নতুন জীবন শুরু করল। মেহুলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হলো। সে জানতো, অরণির মতো কোনো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তার জীবনে আর কখনো আসবে না, কিন্তু সে সে ভালোবাসার প্রতিফলন তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে রাখবে।
শুভ জানতো, তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল—ভালোবাসা কখনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয় না, সেটা চিরকাল থাকে। আর অরণির ভালোবাসা তার জীবনে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
শেষ কথার ভেতর…
একদিন শুভ স্কুলের বাগানে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, অরণি কি কখনো ভেবেছিল, তার চলে যাওয়ার পরেও এমনভাবে সে তার স্মৃতিকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে?
আর যখন আকাশে সুর্য ডুবে যাচ্ছিল, তখন শুভ অনুভব করলো, অরণির ভালোবাসা যেন তার চারপাশে ঘিরে রেখেছে—একটা শান্ত, নীরব ভালোবাসা, যা ছিল নিঃস্বার্থ এবং চিরকালীন।
অরণির সেই ভালোবাসাই এখন শুভর জীবনকে পথ দেখাচ্ছে—যে ভালোবাসা কোনোদিন শেষ হবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন